ব্যাংক খাতের অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য গোপন করতে মরিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের উৎস খুঁজতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের শোকজ করা হচ্ছে। সম্প্রতি অন্তত এক ডজন কর্মকর্তাকে লিখিত শোকজ করা হয়েছে।

এ ছাড়া বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে মৌখিকভাবে শাসানো হয়েছে। এমনকি বদলী, পদোন্নতি বঞ্চিত ও চাকরিচ্যুতির হুমকী দেয়া হচ্ছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন কর্মকর্তারা। সংবাদকর্মীদের সাথে কুশল বিনিময় করলেও জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতের অনিয়ম দুর্নীতি রুখতে চরমভাবে ব্যর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কাছে নতজানু হয়ে পড়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা থোরাই কেয়ার করছে ব্যাংকগুলো। দফায় দফায় নির্দেশনা ও অভিযানের মধ্যেই ডলার বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরী করে শত শত কোটি টাকা মুনাফা করেছে অধিকাংশ ব্যাংক।

ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো একের পর এক সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা । এসব অনিয়ম দুর্নীতি যাতে গণমাধ্যমে প্রকাশ না হয় সে দায়িত্বও কাঁধে নিয়েছেন একজন ডেপুটি গভর্নর। কোন বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের শোকজ করা হচ্ছে। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কর্মকর্তাদের মাঝে সন্দেহ আর অবিশ্বাস সৃষ্টির ফলে কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে।

তারা বলছেন, ব্যাংকের শাখার ভল্ট থেকে টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে, গোপন করা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। অনৈতিকভাবে গ্রাহককে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে দুরবস্থায় পড়ছে ব্যাংক। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক দৃশ্যমান ব্যবস্থা না নিয়ে, উল্টো কেন এ ধরনের অনিয়মের সংবাদ জনসাধারণের কাছে যাচ্ছে, এবিষয়ে বিরক্ত প্রকাশ করেছে। এসব তথ্য সাধারণ মানুষ যেন না জানতে পারে, এজন্য তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কমে যাওয়া, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। ওই সব অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো খবরের তথ্য কোথা থেকে এলো এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যখনই অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে পরক্ষণেই ওই সংবাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মীদের শোকজ করা হচ্ছে।

জানা গেছে, ডিপার্টমেন্ট অব অফ-সাইট সুপারভিশন, পরিদর্শন, ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ, ফরেক্স রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট ও অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের যুগ্ম পরিচালক থেকে শুরু করে নির্বাহী পরিচালক পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ১০-১২ জন কর্মকর্তাকে এরইমধ্যে শোকজ করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আসার পর প্রথমে সাংবাদিকদের প্রবেশে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেন। এর প্রতিবাদে ওই বিটের সাংবাদিকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবধরনের প্রগ্রাম বয়কটের ঘোষণা দেন। পরে এ সিদ্ধান্ত থেকে সড়ে আসেন গভর্নর । অভিযোগ রয়েছে ডেপুটি গভর্নর-২ কাজী ছাইদুর রহমান নতুন গভর্নরকে ভুল বুঝিয়ে এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছিলেন।

ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার হলেও নতুন করে কয়েকটি বিভাগে বিনা নোটিশে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি রাখা হয়েছে। এতে ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‍‍রিজার্ভ নিয়ে একটা সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান স্যার আমাকে ডেকে নিয়ে বকাঝকা করলেন। কেন সাংবাদিকদের সঙ্গে তথ্য শেয়ার করলাম তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। অথচ আমি কিছুই জানি না, তথ্যও দেইনি। তারপরও আমি মানষিক নির্যাতনের শিকার হলাম।‍‍

উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ভয় আর আতঙ্কে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাও বলছেন না। দেখেও এড়িয়ে যাচ্ছেন। কয়েকটি ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যাংকে না যাওয়ার অনুরোধ করেন।

সূত্রের তথ্যমতে, শুধু কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি নয়, সম্প্রতি সময়ে তিনি (ডেপুটি গভর্নর-২) দায়িত্বে নেই এমন অনেক বিভাগের ফাইলপত্র নিয়ে খবরদারি করছেন। গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারে বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হয়। তবে তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহ করে। তাই নির্দিষ্ট করে কোন কর্মকর্তাকে দোষারোপ করার সুযোগ নেই। প্রতিদিনই সাংবাদিকরা বাংলাদেশ ব্যাংকে আসছেন, বিভিন্ন তথ্য নিয়ে সংবাদ করছেন। তবে এ কারণে কোনো কর্মকর্তাকে শোকজ করা হয়েছে, এমন কোনো বিষয় আমি জানি না।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের আচরণ দেশ ও দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আগে শুনিনি। কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

জানা গেছে, ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কেলেঙ্কারির সময় সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। ডেপুটি গভর্নর হিসেবে যোগদানের পরই সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে বিভিন্ন বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সময়ে দায়িত্বে নেই এমন সব বিভাগের সিদ্ধান্তেও হস্তক্ষেপ করা শুরু করেছেন তিনি। এতে করে অন্যান্য ডেপুটি গভর্নররা বিব্রত। এছাড়া তার এমন একপেশি আচরণের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলছেন না। কারণ তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানব সম্পদ উন্নয়ন (এইচআরডি) বিভাগের দায়িত্বে আছেন। কেউ কোনো কথা বললেই তার পদোন্নতি আটকে দেবেন বলে হুমকি দেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান গণমাধ্যম কর্মীদের কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

তথ্যসূত্র: আমার সংবাদ